চব্বিশের চেতনায় পঁচিশের পথচলা

আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ষোলোই ডিসেম্বর। দীর্ঘ দুই যুগের সংগ্রাম আর প্রায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ওই দিনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তবে দীর্ঘ অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের সাফল্যের মাত্রা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থেকে যায়। তাই প্রয়াত অধ্যাপক ও মুক্তমনা লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর একটি বইয়ের শিরোনাম করেন ‘আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’। এই বইয়ের ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ক্রমশ হয়ে উঠেছে একটি নির্মম হাজত। এ অবস্থায় আমি কী’করে বটছায়াতলে বসে ধ্যান করি? শুধু হাহাকার জাগে : আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এই কি আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ, সোনার বাঙলা? এই মানবাধিকারহীন বন্দি শিবির? এই কুষ্ঠাগার? এই ভাগাড়? এই নরক? এই ডাকাত পল্লী? এই দুর্বৃত্তকবলিত চর? এই পঙ্গু হাসপাতাল? এই নর্দমা চেয়েছিলাম আমরা?’
Read More News

আগামী প্রকাশনী ২০০৩ সালের বইমেলায় (ফেব্রুয়ারি) ১২০ পাতার এই বইটি প্রকাশ করেছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে এই বই প্রকাশিত হয়। এরপর আমরা সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকার এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত টানা ১৬ বছর পেয়েছি শেখ হাসিনার শাসন। দীর্ঘ এই (২+১৬) ১৮ বছরের শাসনে ড. হুমায়ুন আজাদের উত্থাপিত কোনো একটি প্রশ্নেরও ধ্বনি-প্রতিধ্বনি থামেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্নের প্রতিধ্বনি হয়েছে তীব্র থেকে তীব্রতর। যেমন, নির্মম হাজত কিংবা বন্দিশিবিরকে টেক্কা দিয়েছে ‘আয়নাঘর’। ডাকাতপল্লী বাংলাদেশের বদলে স্থাপিত হয়েছে দুবাই কিংবা কানাডার বেগমপাড়া। সেদিনের সেই ভাগাড় কিংবা দূষিত ডোবার সঙ্গে নতুন করে আমরা অতিরিক্ত হিসেবে পেয়েছি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তকমা। চরের মাটি অবৈধভাবে বিক্রির কারণে ড. হুমায়ুন আজাদের দেখা সেদিনের দুর্বৃত্তকবলিত চরই গায়েব হয়ে নদীপাড়ের রাস্তা কিংবা নদীর ওপরের সেতুর অস্তিত্ব বিলীন করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পঙ্গু হাসপাতালের বদলে পঙ্গু হয়েছে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সরকারি খাল আর নর্দমার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুতল ভবন। আসলেই আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?

চব্বিশের চেতনা নিয়ে পঁচিশে নতুন পথচলা শুরু করতে হবে। কেবল আশার বাণী নয়, সম্ভব-অসম্ভব এবং চ্যালেঞ্জিং সবকিছু নিয়েই ভাবতে হবে। তাই জুলাই ও চব্বিশের চেতনা নিয়েই শুরু হোক পঁচিশের পথচলা
চব্বিশের চেতনায় পঁচিশের পথচলাএমনই এক পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে চব্বিশের জুলাই বিপ্লব। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তখন স্বাধীনতা শব্দটি আবারও জোরেশোরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে চারদিকে। কেউ বললেন দেশ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হলো, আবার কারও দৃষ্টিতে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা পেল- ইত্যাদি। মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নানাভাবে অংশ নিয়েছিলেন, জীবনের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন বা আপনজনদের হারিয়েছিলেন, এমন কথাগুলো তাঁদের ভালো লাগার কথা নয়। কারণ কেউ যদি এমন কথার বিপরীতে প্রশ্ন করে যে তাহলে কি একাত্তরের স্বাধীনতা মূল্যহীন ছিল? তবে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। আবার এটাও বড় প্রশ্ন যে একাত্তরের ডিসেম্বর থেকে চব্বিশের জুলাই- এই মেয়াদে আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি কিংবা মুক্তচিন্তা ও স্বাধীনভাবে বলা ও লেখার স্বাধীনতা আসলে কতটুকু উপভোগ করেছে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করা এই বাংলাদেশ? তবে আশার কথা, জুলাই ২৪ বিপ্লবের বীর, অকুতোভয় তরুণ প্রজন্ম তাদের ভাবনায় একাত্তরের স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করে। সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবসে দেশের একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা একাত্তরের একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও চব্বিশের আন্দোলনে দুইজন তরুণ নেতা-নেত্রীর কথোপকথন ও ভাবনা তুলে ধরেছে মূল সংবাদ হিসেবে। পাকিস্তানের সেনানিবাসে কর্মরত মেজর তাহের (ফাঁসিতে মৃত্যু), মেজর মনজুর (জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর নিহত), মেজর জিয়াউদ্দিন ও মেজর বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীরপ্রতীক) জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষীদের মোকাবিলা করে ভারতে ঢোকেন। মেজর মনজুরের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, দুই সন্তান ও একজন বাঙালি সৈনিক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা সম্মুখ রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেন। মেজর পাটোয়ারী (পরবর্তী সময়ে কর্নেল ও বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত) কে নিয়ে পত্রিকাটির আয়োজনে চব্বিশের তরুণ নেতা-নেত্রী আরিফ ও নাজিফা গিয়েছিলেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। কথা প্রসঙ্গে তাঁরা দুজনই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা করা বা মিলিয়ে দেখার বিপক্ষে ছিলেন। তারুণ্যের এই চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের আশা জাগায়।

এই তরুণদেরই বাংলাদেশের হাল ধরতে হবে। নতুন চিন্তা ও নতুন ভাবনা নিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের শিক্ষাকে মেলাতে হবে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে। কত জায়গায় যে কাজ করতে হবে তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা করাও কঠিন। এই তরুণরা বিপ্লব ঘটিয়ে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনলেও আগের সংবিধান অবিকৃত রয়ে গেছে, যেখানে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় অর্থাৎ ভোট ছাড়া ক্ষমতা গ্রহণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদি ধরে নেওয়া যায়, বর্তমান সরকার প্রণীত সংবিধান সংশোধন কমিটি এই বিপ্লবকে স্বীকৃতি দেবে এবং এ-সংক্রান্ত কোনো মামলা ভবিষ্যতে হবে না, তবে প্রশ্ন উঠবে নতুন সংবিধানের এই ধারা কত দিন টিকবে? কারণ একসময় পঁচাত্তরের কুশীলবদেরও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই কুশীলবদের অনেককেই ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে অথবা দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। সুতরাং সবদিক মাথায় রেখেই এগোতে হবে তরুণদের। আসছে ১১ জানুয়ারি এক-এগারো তথা ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকার প্রতিষ্ঠার ১৮তম বার্ষিকী পালিত হবে। মনে রাখতে হবে যে অনেক কারণেই সেনা-সমর্থিত সে সরকার স্থায়ী হতে পারেনি। ওই সরকারের কুশীলবদের অনেকেই এখন দেশ ছাড়া এবং লোকচক্ষুর আড়ালে। অনেক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে এক-এগারো সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা। দুঃখের বিষয় বর্তমান সরকারও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। দীর্ঘ ষোলো বছর আন্দোলন করে ঐতিহ্যগতভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যা করতে পারেনি, অনেক কম সময়েই তা করে দেখিয়েছে তরুণরা। সর্বোপরি দেশের সেরা ও মেধাবী সন্তানরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। দেশের আপামর খেটে খাওয়া মানুষ তরুণদের চব্বিশের অর্জন তখনই মূল্যায়ন করবে, যখন সে সন্তানদের মুখে নিশ্চিন্তে খাবার তুলে দিতে পারবে। কিন্তু দেশে টিসিবির পণ্য বা ওয়ার্ডভিত্তিক স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্য লাভের দোকানের সামনে লম্বা লাইনই বলে দেয় কেমন আছে বাংলাদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।

ভালো নেই উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত সমাজও। বাকস্বাধীনতা আর দেশবিরোধী প্রচারণা ও ব্যক্তির চরিত্র হরণ এক হতে পারে না। বিশেষত উচ্চতর নিয়োগ পাওয়া যে কোনো ব্যক্তি, দেশ, জনগণ ও রাষ্ট্রের বিবেচনায় কেবল ব্যক্তিবিশেষ থাকেন না, তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। একসময় কেবল রাজনৈতিক আশ্রয় ও এই সূত্রে ভিনদেশি নাগরিকত্ব লাভের আশায় বিদেশ থেকে দেশ ও সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করতেন একশ্রেণির প্রচারক ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশি। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উপার্জনেরও উৎস হয়ে ওঠার পর ভিউ বা লাইক বা কমেন্ট পাওয়ার লোভে শালীনতার ঊর্ধ্বে উঠে অনেকেই প্রথাবিরুদ্ধ কথা বলতে শুরু করেন। কিন্তু তরুণরা এমন একটা পরিবর্তন ঘটানোর পরও যদি সেই একই ভাষায় ক্রমাগত বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, তবে তা হবে দুঃখজনক। সবাই যদি খারাপ হয়, তবে দেশ চালানোর জন্য কাকে খুঁজে নেবে তরুণ প্রজন্ম? এ বিষয়টিও ভাবতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী বিগত দিনের নানা কারণে তাদের ইমেজ হারিয়েছিল। বিশেষত কতিপয় বাহিনীপ্রধান বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন যে এমন সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে কেউ একজন আর ব্যক্তি পরিচয়ে আবদ্ধ থাকে না। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে যান। কেননা তার সততা, নিষ্ঠা ও কর্মগুণের প্রভাব পড়ে পুরো বাহিনীতে। নিচের সারির কর্মকর্তারা তাঁদের বাহিনীপ্রধানকেই অনুসরণ করেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা এমন সব বাহিনীপ্রধান পেয়েছিলাম যে তাঁরা নিজেরা স্বাধীনভাবে দুর্নীতির স্বার্থে পুরো দেশ ও জাতির স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলেন।

সেই একই বাহিনী দিয়ে দেশের সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন। তবু বলা যায়, নিম্নস্তরে যা-ই ঘটুক না কেন অন্তত বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ ও বাহিনীপ্রধানরা আন্তরিকভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে যেভাবে তাঁদের বিরুদ্ধেও বিষোদগার করা হচ্ছে, তা বিশেষত বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি। সকালসন্ধ্যা নিম্নস্তরের সদস্যরা যদি তাঁদের সরকার ও বাহিনীপ্রধানের বিষয়ে এমন বিরূপ প্রচারণা শোনেন, তবে তা অবশ্যই বাহিনী তথা দেশে কুফল বয়ে আনবে।

আগামী দিনে পৃথিবীতে এমন সব পেশা ও কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে যার নাম হয়তো আমরা আজও শুনিইনি। তাই খোলস ছেড়ে চব্বিশের চেতনা নিয়ে পঁচিশে নতুন পথচলা শুরু করতে হবে। কেবল আশার বাণী নয়, সম্ভব-অসম্ভব এবং চ্যালেঞ্জিং সবকিছু নিয়েই ভাবতে হবে। তাই জুলাই ও চব্বিশের চেতনা নিয়েই শুরু হোক পঁচিশের পথচলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *