ভারত ও চীনের মধ্যে দূরত্ব বেশ পুরনো। তবে সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে খুব কম। ১৯৭৫ সালের পর দুই দেশের মধ্যে গত ১৫ জুন রাতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে বহুবার হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রাণহানি না হওয়ায় উত্তেজনা আর বাড়েনি। তবে এবার উত্তেজনা এশিয়া ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে মার্কিন মুলুকের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীও মুখ খুলেছেন বিষয়টি।
ভারতের সেনা কর্মকর্তাসহ ২৩ জন সেনাকে জীবন দিতে হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে চীনা সেনা নিহত হওয়ার দাবি করা হলেও তার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চীনা কর্তৃপক্ষও বিষয়টি স্বীকার করেনি। তবে ভারতীয় সেনাদের নির্মমভাবে হত্যার ছবি প্রকাশ হয়েছে। পেরেক লাগানো লোহার লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কয়েক জনের মৃত্যু দেহ দেখে চেনার উপায় নাই। তাদের আইডি কার্ড ও নেমপ্লেট দেখে শনাক্ত করতে হয়েছে।
Read More News
ঘটনা নিয়ে চীন-ভারত একে অপরকে দোষারোপ করলে ঘটনার রাতে আসলে কি ঘটেছিল তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো বার্তা নেই। তবে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, চীনা সেনারা অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল। আবার কোনো কোনো মিডিয়ায় খবর প্রকাশ করা হয়েছ, চীনা সেনারা এগিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমে পানি ছেড়ে দিয়ে তাদের ভাসিয়ে দেয়া হয়। তারা যখন হতভম্ব হয়ে পড়ে তখন চীনা সেনারা হামলা চালায়। একতরফা হামলা চালিয়ে ভারতীয় সেনাদের হত্যা করা হয়।
তবে কয়েক সপ্তাহ আগে গালওয়ান নদীর পাশের সকল হাইট (পাহাড়ের চূড়া) দখলে নিয়েছে চীন। সেখানে তারা স্থাপনাও তৈরি করছে। ভারতীয় সেনাদের উদ্দেশ্য ছিল স্থাপনা নির্মাণে বাধা দেয়া। ভারতীয় সেনারা স্থাপনা নির্মাণে বাধা দিতে চেয়েছিল এ তথ্য এনডিটিভিসহ ভারতের বহু গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে ভারতীয় সেনারা সরাসরি বাধা দেয়ার আগে দুই দেশের সেনাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে দুই দেশ একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। সীমান্তের দুই কিলোমিটারের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে না বলে একমত হয়। হয়তো সে কারণেই চীনা সেনারা আগ্নেয়াস্ত্রের বিকল্প হিসেবে পেরেক লাগানো লোহার লাটি প্রস্তুত করে। ভারতীয় সেনারা যখন চীনা সেনাদের হাতের নাগালে পৌঁছে তখন ওই অস্ত্র দিয়েই তাদের ঘায়েল করা হয়।
তবে ওই রাতের ঘটনা ভারত লুকিয়ে ফেলার বা সামান্য ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করার চেষ্টা করে। প্রথমে জানানো হয়েছিল মাত্র ৩ জন সেনা নিহত হয়েছে। কিন্তু পরে জানা যায়, ২৩ জন সেনা নিহত হয়েছে। ভারত সরকার বিষয়টি লুকোচুরি করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল, চীনা সেনারা ভারত সীমান্তে প্রবেশ করে অন্যায়ভাবে এ হামলা চালিয়েছে। কিন্তু পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বার্তায় বলা হয়, কোনো দেশের সেনারা ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করেছি, স্থাপনাও তৈরি করেনি। অবশ্য এই বক্তব্যের পর সরকার একটু বিপাকে পড়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্লেষকরাও প্রশ্ন তুলেছে তাহলে কি ঘটেছিল? তবে তার এখনো কোনো উত্তর দেয়নি ভারত সরকার।
আনন্দবাজার, জি নিউজ ও এনডিটিভিসহ একাধিক গণমাধ্যমে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, ৬ জুনের পর থেকে চীন নদীর পানি আটকে রাখে। তাদের স্থাপনা নির্মাণে বাধা দিতে ভারতীয় সেনারা সেখানে যাবে এমন খবর তাদের কাছে আগেই ছিল। এজন্য তারা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। ঘটনার রাতে যখন ভারতীয় সেনারা নদী-পথ থরে এগোতে থাকে তখন চীনারা সেনা জানতে পারে। ভারতীয় সেনারা চীনা সেনাদের কাঙ্ক্ষিত এলাকায় যখন পৌঁছে তখন তারা নদীর পানি ছেড়ে দেয়। এতে পানির স্রোতে ভেসে যায় ভারতীয় সেনারা। হতবিহবল হয়ে পড়ে তারা।
আকস্মিক এমন পরিস্থিতিতে পড়ে ভারতীয় সেনারা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকে। এজন্য কেউ পানি থেকে পাহাড়ে, কেউ নদীর কানায় আশ্রয় নেয়। ভারতীয় সেনারা যখন আহত ও বিপর্যস্ত অবস্থায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন তাদের ওপর হামলা করে চীনা সেনারা। আহত সেনাদের পেরেক লাগানো লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। কারো কারো মুখ পুরো থেঁতলে যায়। আহত ১০ জনকে আটক করে নিয়ে যায় লাল ফৌজের দল।
১৭ হাজার ফুট উঁচু সীমান্তে, রক্ত জমানো শীতের রাতে, সেনাদের আর্তনাদ ও কান্নার আওয়াজ আকাশে বাতাসে গুঞ্জরিত হতে থাকে। চারদিকে এক আতংক ও বিভীষিকাময় পরিবেশ তৈরি হয়। আহতদের চিকিৎসা করার জন্য ছিল না তেমন ব্যবস্থা। যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল ভঙ্গুর। নিরস্ত্র সেনাদের শীত নিবারণের জন্য পর্যাপ্ত কাপড়ের ব্যবস্থাও ছিল না।
খবর পেয়ে ভারতীয় সেনা বাহিনীর গাড়ি বহর পৌঁছে সেখানে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। ভারতীয় প্রশাসন ও আর্মি ঘটনা জেনে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়ে সব লুকাতে। কিন্তু চীনারা আবার এক আঘাত করল, তারা সরাসরি রাতের ঘটনা বিশ্বকে জানিয়ে দিল।